
বাংলা ভাষার উৎপত্তি কোন ভাষা থেকে এসেছে? প্রাচীন শিকড়ের গভীর বিশ্লেষণ
আপনি কি কখনও ভেবে দেখেছেন, বাংলা ভাষার উৎপত্তি কোন ভাষা থেকে? এই প্রশ্নটি কেবল ভাষাতাত্ত্বিক কৌতূহল নয়, এটি আপনাকে নিয়ে যাবে আমাদের জাতিগত ইতিহাস, সাংস্কৃতিক শিকড় এবং আত্মপরিচয়ের গভীরে। আপনি প্রতিদিন যে ভাষায় কথা বলেন, ভাবেন, গান শুনেন বা বই পড়েন—সেই ভাষার পেছনে রয়েছে হাজার বছরের বিবর্তন, সংমিশ্রণ ও ঐতিহ্য।
বাংলা শুধু একটি ভাষা নয়, এটি একটি জীবন্ত সংস্কৃতি। বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম মাতৃভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা বর্তমানে প্রায় ৩০ কোটির বেশি মানুষের মুখের ভাষা। তবে এই গর্বিত ভাষাটির যাত্রা আজকের মতো সহজ ছিল না। ভাষার ইতিহাস ঘাঁটলে আপনি দেখবেন, এটি নানা পর্যায় পেরিয়ে আজকের আধুনিক রূপ পেয়েছে। সেই রূপান্তরের শুরু কোথা থেকে, তা জানার আগ্রহ থেকেই আসে প্রশ্ন—বাংলা ভাষার উৎপত্তি কোন ভাষা থেকে?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আপনাকে ফিরতে হবে হাজার বছরের প্রাচীন ইতিহাসে—ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার শিকড় থেকে শুরু করে প্রাকৃত, অপভ্রংশ, আর পরবর্তীতে বাংলা হিসেবে আত্মপ্রকাশের রূপরেখা পর্যন্ত। এটি শুধু ইতিহাস জানার জন্য নয়, বরং নিজের মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা গভীর করতে হলে এর উৎস জানাটা খুবই জরুরি।
সূচিপত্রঃ
বাংলা ভাষার গোষ্ঠীর পরিচয়
আপনার যে বাংলা ভাষা আজকে এত স্বাভাবিক ও আপন মনে হয়, সেটি আসলে একটি বহুপার্যায়ের বিবর্তনের ফল। ভাষাতাত্ত্বিকভাবে বাংলা ইন্দো–ইউরোপীয় (Indo-European) ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। আপনি যদি এই গোষ্ঠীর পরিচয় জানতে চান, তাহলে জেনে রাখুন—এই পরিবারে আছে ইংরেজি, জার্মান, ফরাসি, হিন্দি, উর্দু এবং আরও বহু ভাষা। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বিস্তৃত ভাষাগোষ্ঠীগুলোর একটি।
তবে ইন্দো–ইউরোপীয় পরিবার থেকেও বাংলা এসেছে আরও নির্দিষ্ট একটি শাখা—ইন্দো–আর্য (Indo-Aryan)। এই শাখার মধ্যে হিন্দি, পাঞ্জাবি, ওড়িয়া, মারাঠি, গুজরাটি ইত্যাদির পাশাপাশি বাংলা ভাষাও অন্তর্ভুক্ত। এখন আপনি ভাবতে পারেন, এখান থেকে সরাসরি কি বাংলা তৈরি হয়েছে? না, বাংলা এসেছে আরও নিচের একটি উপশাখা—পূর্ব ইন্দো–আর্য (Eastern Indo-Aryan) থেকে। এই উপশাখাতেই রয়েছে অসমিয়া, ওড়িয়া ও বাংলা ভাষা।
আপনি যখন প্রশ্ন করেন, বাংলা ভাষার উৎপত্তি কোন ভাষা থেকে, তখন এই গঠনমূলক ভাষাগত সম্পর্ক বোঝা অত্যন্ত জরুরি। বাংলা ভাষার ভিত্তিতে রয়েছে সংস্কৃত, তবে সরাসরি নয়। বরং এর রূপ গঠিত হয়েছে একাধিক মধ্যবর্তী ভাষার হাত ধরে, যেগুলোর মধ্যে রয়েছে মাগধী প্রাকৃত ও অপভ্রংশ।
এই সম্পর্ক বোঝার মাধ্যমে আপনি শুধু ইতিহাস জানেন না, বরং বুঝতে পারেন, ভাষা কিভাবে পরিবর্তন হয়, গ্রহণ করে, এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন রূপ নেয়। বাংলা ভাষার বর্ণমালা, শব্দভাণ্ডার ও ব্যাকরণেও এর ছাপ স্পষ্ট।
প্রাকৃত থেকে অপভ্রংশ হয়ে বাংলা ভাষার উৎপত্তি
যখন আপনি জানতে চান বাংলা ভাষার উৎপত্তি কোন ভাষা থেকে, তখন আপনাকে ফিরে যেতে হবে প্রায় দুই হাজার বছর আগের ইতিহাসে। তখন ভারতীয় উপমহাদেশে সংস্কৃত ছিল ধর্মীয় ও আচারবিধির ভাষা, কিন্তু সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা ছিল না। সাধারণ মানুষ যে ভাষায় কথা বলত, সেই কথ্য সংস্করণকে বলা হতো প্রাকৃত (Prakrit)।
বাংলা ভাষার মূল শিকড় হচ্ছে মাগধী প্রাকৃত—এটি পূর্ব ভারতের মগধ অঞ্চলে প্রচলিত ছিল, বর্তমানের বিহার ও বাংলার একাংশ মিলিয়ে। এই মাগধী প্রাকৃত থেকে সময়ের ব্যবধানে তৈরি হয় এক ধরনের অঞ্চলভিত্তিক পরিবর্তিত ভাষা, যাকে বলা হয় অপভ্রংশ (Apabhramsa)। এটি ছিল একধরনের আধা-লিখিত ও আধা-কথ্য ভাষা, যা প্রাকৃত ও স্থানীয় উপভাষার সংমিশ্রণে তৈরি হয়েছিল।
ধারাবাহিকভাবে এই অপভ্রংশ ভাষা থেকেই গড়ে ওঠে আধুনিক পূর্ব ইন্দো-আর্য ভাষাগুলি—এর মধ্যে বাংলা একটি প্রধান। অনেক ভাষাবিদ যেমন ডঃ সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় এবং ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এই পথ অনুসরণ করেই বাংলা ভাষার উৎপত্তি ব্যাখ্যা করেছেন। শহীদুল্লাহ মনে করেন, গৌড় অঞ্চলে ব্যবহৃত গৌড়ীয় অপভ্রংশ ধীরে ধীরে বাংলায় পরিণত হয়।
এই প্রক্রিয়ায় শব্দভাণ্ডার, ধ্বনিগত পরিবর্তন, ক্রিয়া রূপান্তর—সব কিছুতেই আসে পরিবর্তন। যেমন, সংস্কৃত শব্দ “সপ্ত” অপভ্রংশ হয়ে বাংলায় হয়ে যায় “সাত”, বা “মাতৃ” হয় “মা”। এমন হাজারো উদাহরণে বাংলা ভাষার বিবর্তন দৃশ্যমান।
বাংলা ভাষার বিবর্তন: প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক পর্যায়
আপনি যেই বাংলা ভাষায় কথা বলেন, তা কিন্তু বহু শতাব্দীর বিবর্তনের ফসল। ইতিহাসবিদ এবং ভাষাতত্ত্ববিদরা বাংলা ভাষার বিকাশকে তিনটি প্রধান পর্যায়ে ভাগ করে দেখেন—প্রাচীন বাংলা, মধ্য বাংলা এবং আধুনিক বাংলা। এই প্রতিটি ধাপেই ভাষার ধ্বনি, শব্দ, ব্যাকরণ এবং রচনাশৈলীতে এসেছে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন।
প্রাচীন বাংলা (৮ম–১২শ শতক)
প্রাচীন বাংলার প্রধান নিদর্শন হিসেবে রয়েছে চর্যাপদ। এটি মূলত বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের ধর্মীয় গানের সংকলন, যেখানে ব্যবহার করা হয়েছিল বাংলার প্রাচীন রূপ। আপনি হয়তো জানেন না, চর্যাপদের ভাষা পুরোপুরি বাংলা ছিল না—তবে এটি এমন একটি রূপ ছিল যা পরবর্তী বাংলা ভাষার ভিত্তি গড়ে তোলে। এই সময়ের বাংলা ছিল ধ্বনিগতভাবে সরল, ব্যাকরণে স্থিতিশীল এবং সংস্কৃতনির্ভর শব্দ ছিল কম।
মধ্য বাংলা (১৩শ–১৮শ শতক)
এই পর্যায়ে বাংলা ভাষার ওপর ফারসি ও আরবি প্রভাব স্পষ্টভাবে লক্ষ করা যায়। মুসলিম শাসন ও সাহিত্য চর্চার ফলে বাংলা ভাষা উপভাষাগুলোর সংমিশ্রণে আরও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। এই সময় বাংলায় উপন্যাস, কবিতা, ইতিহাসচর্চা শুরু হয়। বাংলা ভাষায় গড়ে ওঠে সাহিত্যিক ভাষা ও রচনাশৈলী। মধ্য বাংলায় ‘আছে’ রূপটি ‘আছে’ থেকে ‘আছে গো’, ‘করিলা’ রূপে প্রচলিত হয়েছিল—যা আপনি মধ্যযুগীয় সাহিত্যে স্পষ্ট দেখতে পারবেন।
আধুনিক বাংলা (১৮শ শতক থেকে বর্তমান)
বাংলা ভাষার এই পর্যায় মূলত শুরু হয় ইউরোপীয় আধিপত্য এবং মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কারের পর। এই সময় ভাষা আরও মান্য ও প্রমিত রূপ লাভ করে। ঋণ শব্দ, বিশেষ করে ইংরেজি থেকে আগত, এই পর্যায়ে বাংলা ভাষায় স্থান করে নেয়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো মনীষীদের হাত ধরে আধুনিক বাংলা গড়ে ওঠে। ব্যাকরণগত ও সাহিত্যিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা পায়।
আপনি যদি একটিবার চিন্তা করেন, বাংলা ভাষার উৎপত্তি কোন ভাষা থেকে, তাহলে বুঝবেন—এই উত্তরের পুরো চিত্র জানতে হলে আপনাকে এই তিনটি ধাপ গভীরভাবে অনুধাবন করতে হবে।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন
১. বাংলা ভাষার উৎপত্তি কোন ভাষা থেকে?
উত্তর: বাংলা ভাষার উৎপত্তি মাগধী প্রাকৃত ভাষা থেকে, যা সময়ের সঙ্গে গৌড়ীয় অপভ্রংশ হয়ে প্রাচীন বাংলার রূপ নেয়। এটি পূর্ব ইন্দো–আর্য ভাষাগোষ্ঠীর একটি শাখা।
২. বাংলা কি সরাসরি সংস্কৃত থেকে এসেছে?
উত্তর: না, বাংলা সরাসরি সংস্কৃত থেকে আসেনি। যদিও বাংলা ভাষায় বহু সংস্কৃত শব্দ রয়েছে, তবে এর বিবর্তন ঘটেছে প্রাকৃত ও অপভ্রংশের মাধ্যমে, যেগুলো সংস্কৃতের পরিবর্তিত রূপ।
৩. চর্যাপদ কি বাংলা ভাষার প্রথম নিদর্শন?
উত্তর: হ্যাঁ, চর্যাপদকে বাংলা ভাষার প্রাচীনতম সাহিত্যিক নিদর্শন হিসেবে ধরা হয়। এটি ৮ম থেকে ১২শ শতাব্দীর মধ্যে রচিত হয়েছিল এবং এতে প্রাচীন বাংলা ভাষার উপাদান রয়েছে।
৪. বাংলা ভাষা কবে “স্বতন্ত্র ভাষা” হিসেবে বিবেচিত হয়?
উত্তর: বাংলা ভাষা মধ্যযুগে এসে নিজস্ব রূপ পেতে শুরু করে এবং ১৩শ শতকের পর থেকে একে স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে ধরা হয়, যখন সাহিত্য ও প্রশাসনিক কাজেও বাংলার ব্যবহার শুরু হয়।
৫. অপভ্রংশ বলতে কী বোঝায়?
উত্তর: অপভ্রংশ হলো প্রাকৃত ভাষার পরিবর্তিত ও অঞ্চলভিত্তিক রূপ, যা ধীরে ধীরে লিখিত ভাষায় ব্যবহৃত হয় এবং নতুন ভাষার জন্ম দেয়। বাংলা, হিন্দি, ওড়িয়া ইত্যাদি ভাষা অপভ্রংশ থেকে তৈরি হয়েছে।
৬. বাংলা ভাষায় ফারসি ও ইংরেজির প্রভাব কিভাবে এসেছে?
উত্তর: মুসলিম শাসনামলে প্রশাসনিক ও সাহিত্যিক কারণে বাংলায় ফারসি ও আরবি শব্দ এসেছে। পরে ব্রিটিশ শাসনের সময় ইংরেজি শব্দ বাংলায় অন্তর্ভুক্ত হয়, বিশেষ করে আধুনিক বাংলা ভাষায়।
৭. আজকের বাংলা ভাষার ব্যাকরণ কীভাবে গঠিত হয়েছে?
উত্তর: আধুনিক বাংলা ভাষার ব্যাকরণ প্রমিত রূপ পেতে শুরু করে ঊনবিংশ শতকে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও অন্যান্য পণ্ডিতেরা এই সময় বাংলা ব্যাকরণ গঠন করেন এবং শুদ্ধ ভাষাচর্চার ভিত্তি স্থাপন করেন।
উপসংহার
আপনি যদি গভীরভাবে ভাবেন, বাংলা ভাষার উৎপত্তি কোন ভাষা থেকে—এই প্রশ্নের উত্তর শুধু ইতিহাস জানার জন্য নয়, বরং নিজের ভাষার শিকড় বোঝার জন্যও জরুরি। এই ভাষা একদিনে গড়ে ওঠেনি। এটি এসেছে মাগধী প্রাকৃতের মতো প্রাচীন কথ্যভাষা থেকে, পেরিয়েছে অপভ্রংশের ধাপ, গড়ে উঠেছে প্রাচীন বাংলা, গেয়েছে চর্যাপদ, আর আজ পৌঁছেছে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর যুগে।
প্রাচীন যুগে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের ভাষা ছিল সংস্কৃত, কিন্তু সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা ছিল প্রাকৃত। সময়ের পরিবর্তনে সেই প্রাকৃত যখন আরও সহজ-সরল রূপে কথ্য এবং লেখ্য ভাষায় ব্যবহৃত হতে লাগল, তখন জন্ম নেয় অপভ্রংশ। আর অপভ্রংশ থেকেই ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে বাংলা।
আপনি আজ যে ভাষায় কথা বলেন, লিখেন, গান শোনেন বা সাহিত্য পড়েন—তা এক বিশাল ঐতিহাসিক ভান্ডার ও সংস্কৃতির উত্তরাধিকার। তাই বাংলা ভাষা কেবল একটি মাধ্যম নয়, এটি এক ঐতিহ্য, এক পরিচয়, এক গর্ব।
শেষ কথায়, এই ভাষার গভীরতা বুঝতে গেলে আপনাকে ইতিহাস, ভাষাবিজ্ঞান এবং সংস্কৃতির মেলবন্ধনে তাকাতে হবে। আর তখনই পরিষ্কারভাবে জানতে পারবেন, বাংলা ভাষার উৎপত্তি কোন ভাষা থেকে, এবং কিভাবে শত শত বছরের বিবর্তন এই ভাষাকে আজকের অবস্থানে নিয়ে এসেছে।