Tech

সামিট গ্রুপের সিঙ্গাপুরে নিবন্ধনের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানিখাত যেভাবে লাভবান হয়েছে 

জন্মলগ্ন থেকেই সামিট গ্রুপ  ও এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খানের বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের সাথে আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ সম্পন্ন করার পর, মুহাম্মদ  আজিজ খান নিজের মেধা এবং যোগ্যতাকে বিলিয়ে দিয়েছেন দেশ ও দেশের মানুষের উন্নতির জন্য। দেশের উন্নতির এই সার্বক্ষণিক চিন্তা থেকেই তিনি তাঁর বৃহৎ ব্যবসার একটা উল্লেখযোগ্য অংশ সিঙ্গাপুর এ সরিয়ে নেন। 

অনেকেই ভাবছেন এতে বাংলাদেশের কী লাভ হলো? সেই বিস্ময়কর গল্পই আজ আপনাদের বলব। ২০১৬ সালে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনাল সিঙ্গাপুরে ব্যবসায়িক নিবন্ধিত হয়। আপাত দৃষ্টিতে এটি স্ববিরোধী উদ্যোগ মনে হলেও, এই উদ্যোগের মাধ্যেম বাংলাদেশে অত্যন্ত স্বল্প খরচে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করার সুযোগ করে দিয়েছে সামিট গ্রুপ। 

প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই মুহাম্মদ আজিজ খানের অন্যতম দুটি লক্ষ্য ছিল মানুষের ঘরে ঘরে বিদ্যুৎসেবা নিশ্চিত করা এবং নিজের ব্যবসায়িক ভিত্তিকে শক্তিশালী করা। এই ভাবনা থেকেই ১৯৯৭ সালে সামিট  বাংলাদেশের প্রথম স্বতন্ত্র বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী (আইপিপি) হিসেবে বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। 

মুহাম্মদ আজিজ খান বলেন “ওই সময় (১৯৯৭ সালে) বাংলাদেশের মাত্র ২০-২৫ শতাংশ মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ ছিল। বর্তমানে আমরা তা শতভাগে নিয়ে যেতে পেরেছি। সামিট গ্রুপ এই যাত্রার অংশীদার হতে পেরে একই সাথে আনন্দিত এবং গর্বিত।“

বর্তমানে বাংলাদেশের মোট বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার ১৭ ভাগ যোগান দেয় সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনাল, যা একই সাথে বাংলাদেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার শতকরা ৭ ভাগ। 

সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনাল একই সাথে বাংলাদেশের দ্বিতীয় ফ্লোটিং স্টোরেজ অ্যান্ড রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট (এফএসআরইউ)-এর মালিকানা ও পরিচালনার দায়িত্বে আছে, যা দৈনিক ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি পুনরায় তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসে রূপান্তরিত করতে সক্ষম

সামগ্রিকভাবে এসব ব্যবসায়ীক উদ্যোগ সামিট গ্রুপকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়, যার শুরুটা হয়েছিল বাংলাদেশের মানুষের ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্য থেকে। 

See also  Google-এর মাধ্যমে কীভাবে মেসেজ পাঠানো যায়: একটি সহজ গাইড

সিঙ্গাপুরে নিবন্ধন কেন সামিটের অত্যাবশ্যক ছিল?

প্রথমত, বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহের পন্থা বোঝার জন্য সামিট গ্রুপের গঠন কাঠামো বোঝাটা জরুরী। সামিট বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ অবকাঠামো উন্নয়নকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে। সামিটের বিদ্যুৎ, জ্বালানি, ফাইবার অপটিকস, বন্দর ও অবকাঠামো খাতে বিপুল বিনিয়োগ আছে এবং এই গ্রুপের অধীনে ছয় হাজারের অধিক কর্মী নিয়োজিত আছেন। সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনাল বিদ্যুৎ এবং জ্বালানী খাতের পুরো বিষয় টা দেখভাল করে। 

২০১৬ সালে আজিজ খান বিশ্ব ব্যাংক গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (আইএফসি) এবং  অন্যান্য বিশ্বখ্যাত বিনিয়োগকারীদের সাথে একটি অংশীদারি চুক্তি করেন। এই চুক্তির ভিত্তিতেই সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনাল সিঙ্গাপুরে গঠিত হয়। 

উল্লেখ্য এই চুক্তির আগেও সামিটের বেশ কিছু প্রকল্পে আইএফসি আর্থিক বিনিয়োগ করেছে। আইএফসি, বিশ্ব ব্যাংক গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান, যা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। 

মুহাম্মদ আজিজ খান এর সিঙ্গাপুরে নিবন্ধিত হবার এই দূরদর্শী পদক্ষেপ সামিট এর কর্পোরেট অনুশাসন নিশ্চিত করেছে এবং একই সাথে সিঙ্গাপুরের আর্থিক অবকাঠামোর সাথে পরিচিত হবার সুযোগ করে দিয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে বিশ্বব্যাপী বড় বড় এবং স্বনামধন্য বিনিয়োগকারীদের কাছে সামিট নিজের শক্ত অবস্থান তৈরি করতে পেরেছে। 

মুহাম্মদ আজিজ খান এই প্রসঙ্গে বলেন, “বাংলাদেশে ব্যবসা বাড়ানোর প্রচুর সুযোগ রয়েছে। কিন্তু এখানে আর্থিক কাঠামো আর বাজার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সুগঠিত নয়। দীর্ঘমেয়াদী অবকাঠামোগত উন্নয়ন এর জন্য এই দুটি বিষয়ের বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে সিঙ্গাপুরে নিবন্ধন সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালকে এসব সুবিধাদি দিয়েছে।“

সামিট গ্রুপের সাথে বৈদেশিক অংশীদারিত্ব সুলভে বিদ্যুৎ সরবরাহের পথকে সুগম করেছে

সিঙ্গাপুরে ব্যবসায়ীক কার্যক্রম শুরুর মাধ্যমে শুধুমাত্র আইএফসি নয় বরং আরও অনেক স্বনামধন্য বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে বিনিয়োগ পেতে সামিট গ্রুপকে সাহায্য করেছে।  আমেরিকান কোম্পানি জেনারেল ইলেক্ট্রিক (জিই) সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালের সাথে একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে অংশীদার হয়েছে। একইভাবে এফএসআরইউ স্থাপনে সামিটের সাথে স্বনামধন্য জাপানি কোম্পানি মিতসুবিশি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এদিকে জাপানের অন্যতম বৃহৎ বিদ্যুৎ কোম্পানি জেরা ২০১৯ সালে সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালের ২২ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয়। 

See also  Facebook Stylish Bio: আপনার প্রোফাইলকে আরও আকর্ষণীয় করুন

সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালের সিঙ্গাপুরে নিবন্ধিত হওয়ার সুবাদে এই বড় বড় আর্থিক চুক্তিগুলো সম্ভব হয়েছে। সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালের চিফ ফাইন্যান্সিয়াল অফিসার (সিএফও) ইয়ান বিন বলেন, “যদি আমরা শুধুমাত্র বাংলাদেশে সীমাবদ্ধ থাকতাম তাহলে জেরার সাথে সমন্বয় করা আমাদের জন্য অনেক কঠিন হতো। কারণ,  এ ধরনের অংশীদারিত্বের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ থেকে আগাম অনুমতি নিতে হতো যা অত্যন্ত সময় ও ব্যয়সাপেক্ষ।“ 

তিনি আরও বলেন, “সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালের ব্যবসায়িক প্রোফাইল বিশ্বখ্যাত বহুজাতিক বিনিয়োগ কোম্পানিগুলোকে বাংলাদেশী প্রকল্পে বিনিয়োগের ব্যপারে আগ্রহী করে তুলেছে।“

প্রচুর মূলধনের নিশ্চয়তা এবং বিদেশী কোম্পানিগুলোর সাথে অংশীদারিত্ব—এই দুটি বিষয় বাংলাদেশের ভোক্তা পর্যায়ে চমৎকার সাফল্য নিশ্চিত করেছে। এ প্রসঙ্গে সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালের চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার (সিইও) আয়েশা খান বলেন, “আমরা খুব সহজে এবং অল্প খরচে আমাদের মূলধন সংগ্রহ করতে পেরেছি, যে কারণে বাংলাদেশে আমরা সর্বনিম্ন মূল্যে ভোক্তাপর্যায়ে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে পারছি। আপনারা যেকোনো সময়ের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাবেন যে সামিটের উৎপাদিত বিদ্যুতের খরচ সমসাময়িক যেকোনো বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে সবসময়ই অনেক কম ছিল এবং থাকবে।” 

টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা সামিট গ্রুপের অন্যতম প্রধান অঙ্গীকার

মুহাম্মদ আজিজ খান মনে করেন তাঁর প্রতিষ্ঠানের বৃদ্ধি এবং বৈদেশিক অংশীদারিত্ব টেকসই আর পরিবেশ বান্ধব বিদ্যুৎ প্রকল্প পরিচালনায় সহায়ক ভূমিকা পালন করে চলেছে। টেকসই উন্নয়ন একই সাথে সামিট গ্রুপ এবং বাংলাদেশ সরকারের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। 

মুহাম্মদ আজিজ খান বলেন, “বাংলাদেশকে খুব দ্রুত কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি থেকে বের হয়ে শিল্পভিত্তিক অর্থনীতির পথে যেতে হবে। সেটা করা না গেলে ১৮০ মিলিয়ন জনগোষ্ঠীর জন্য উপযুক্ত কর্মসংস্থান তৈরি হবেনা। আর শিল্পভিত্তিক অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি হল বিদ্যুৎ।“

একইসাথে মুহাম্মদ আজিজ খান টেকসই ও পরিবেশবান্ধব জ্বালানী প্রকল্পের গুরুত্ব উল্লেখ করে বলেন “বাংলাদেশ সবথেকে কম কার্বন নিঃসরণকারী দেশের তালিকায় রয়েছে। তা সত্ত্বেও আমাদের বিশ্ব পরিবেশের দিকে মনযোগী হতে হবে।“

See also  Banglalink MB Check: সহজ পদ্ধতিতে ইন্টারনেট ব্যালেন্স জানুন

তিনি আরও মনে করেন উন্নত প্রযুক্তি যেমন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আর মেশিন লার্নিং এই ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। 

“কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্য নিয়ে আমাদের কার্বন নিঃসরণ কমাতে হবে যেন আমাদের এই পৃথিবীর মাটি, জলবায়ু এবং পরিবেশ দূষণ মুক্ত থাকে। এটা অবশ্যই কঠিন একটা কাজ কিন্তু অসম্ভব নয়। সামিট গ্রুপ সেই লক্ষে এগিয়ে যাবে নিরন্তর।“

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ব্যবসার বাইরে মুহাম্মদ আজিজ খান দেশে ও বিদেশে মানবসেবায় অবারিত অবদান রেখে চলেছেন। করোনা মহামারির সময় সমাজসেবায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় সিঙ্গাপুরের জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন মুহাম্মদ আজিজ খান। দেশটির সম্মানজনক ‘ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ডস’ পাবলিক সার্ভিস মেডেল (কোভিড-১৯) পেয়েছেন তিনি। 

২০২৩ সালের ২৬ অক্টোবর সিঙ্গাপুর এক্সপোতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তাঁকে এ পদক দেওয়া হয়। সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পক্ষ থেকে দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী অং ইয়ে কং মুহাম্মদ আজিজ খানের হাতে মেডেলটি তুলে দেন।

করোনার সময় ব্যক্তিগতভাবে দায়বদ্ধতা অনুভব করে বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমিকদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন বলে জানান মুহাম্মদ আজিজ খান। 

তিনি বলেন, “আমার জন্মভূমি ও শেকড়ের টানে আমি সিং-হেলথের মাধ্যমে অভিবাসী শ্রমিকদের সর্বোচ্চ সহযোগিতার চেষ্টা করেছি। সেই সময় আমি বাংলাভাষী শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলি।“ আর এ কাজে সহযোগিতা করার জন্য তিনি সিঙ্গাপুরের আইন ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কাশীবিশ্বনাথন শানমুগামের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।

 

Back to top button